দেশ-বাড়ি: শাহবাগ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস ‘পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী’ প্রকাশিত হয় ফেব্রেুয়ারি ২০০৬ এ। দীর্ঘ আট বছর পর প্রকাশিত হলো বর্তমান উপন্যাসটি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রচুর গল্প লিখেছেন। কোন কোন গল্পের আকার প্রায় উপন্যাস ছোঁয়া। কোন কোনটি অনেক লেখকের সংলাপ ধাঁচের, জায়গা খালি রেখে পৃষ্ঠা বাড়িয়ে লেখা উপন্যাস কে ছাড়িয়ে যাবে। তিনি সহজে এই সবগল্পকে একটু অন্য রূপ দিয়ে উপন্যাস হিসেবে চালাতে পারতেন। প্রশ্ন থাকে কেন তিনি এমন করেন না? তিনি তার বৃহৎ গল্পপ্রকল্পকে উপন্যাস বলতে কেন চান না? উপন্যাসেতো যে মাত্রার হোক একটি গল্প অবশ্যই থাকে। তাঁর প্রথম উপন্যাসের গল্পটি দেখি। উপন্যাস পদ্মাপাড়ের দেহপসারিনীদের নিয়ে। বিষয়টা মানবসভ্যতার মতো সমান ধ্রুপদী। নামটাও লক্ষণীয় মহাভারতে বিখ্যাত চরিত্র দ্রৌপদী। যদিও দ্রৌপদী দেহপাসারিণী নন। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ‘বহুজনের একস্ত্রী’ প্রথা ছিল। তবে বিষয়টি ঈসৎ বিতর্কিতও হয়ে থাকতে পারে। তাই পরবর্তীতে এই প্রথাটি সমাজ স্বীকার করেনি। স্বীকার করেনি বলেই এই প্রথা কিছু কিছু দুর্গম উপজাতীয় সমাজে গিয়ে ঠেকেছে। সম্ভবত বিষয়টি বির্তকিত ছিল বলেই হয়তো এতো জনপ্রিয়। তবে দেহপসার যতই বিতর্কিত হোক মানবজাতির মধ্যে এর জনপ্রিয়তার কোন ঘাটতি পড়েনি। এবার আমাদের হাতের উপন্যাসটির দিকে লক্ষ্য করি। এর বিষয়টিও জ্যামিতিক অবস্থানগত দিক থেকে প্রথম উপন্যাসের সাথে একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। মনে রাখি বিষয়টি খুবই জনপ্রিয়। আর ‘বিতর্ক’ প্রথম থেকে এর সাথে লেগেই ছিল। এর বিপক্ষের লোকজন বিতর্ক করবে স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এমন হলো বিপক্ষের লোকের চাইতে পক্ষের লোকেরাই বেশী বিতর্ক করলেন। সরাসরি বলতে গেলে লেখালেখির ক্ষেত্রে বিপক্ষের চাইতেও পক্ষের লোকেরাই চরম বিতর্কিত করে তুললেন। মৌলিকভাবে যারা শাহবাগ আন্দোলনের সাথে প্রথম থেকে ছিলেন লেখালেখির ক্ষেত্রে তারাই তাদের প্রকাশিত দুটি গল্পে চরম বিতর্কের জন্মদেন। যদিও সমকালীন বিষয় নিয়ে সাহিত্য সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। আর উপন্যাসের ক্ষেত্রে ঘটমান বিষয় নিয়ে কোন রচনা আরো ঝুঁকিপূর্ণ। এই ব্যাপক ঝুঁকিটি নিলেন কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে এই ধরনের ঝুঁকি আরো একজন নিয়ে ছিলেন। তিনি আনোয়ার পাশা। মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনা নিয়ে মক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রচনা করেন ‘রাইফেল-রোটি-আওরাত’। এই উপন্যাসটি বহুল আলোচিত প্রধানত এর সমকালীনতার কারণে। সমালোচকগন বারবার এর ঐতিহাসিক মূল্যই তুলে ধরেন। কিন্তু এর সাহিত্যমূল্য নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেন না। আলোচক ফারুক ওয়াসিফ বলছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকটি উপন্যাস আছে আমাদের। লেখা হবে আরো অনেক। কিন্তু রাইফেল রোটি আওরাত অনন্য। আর কেউ একাত্তরের আলো-অন্ধকারের মধ্যে সশরীরে ঢুকে তাকে জানার সুযোগ পাবেন না। আনোয়ার পাশা জেনেছেন এবং জানিয়েছেন।’ এটাই কি এই উপন্যাসের একমাত্র সার্থকতা? যুদ্ধকালে তাঁর শহীদ হওয়াই কি প্রধান উল্লেখ্য? তিনি একটি বাক্যও কি লেখেনি যা নুন্যতম সাহিত্যরস যোগান দিতে পারে?
আমাদের কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীরও শাহবাগ আন্দোলনের একেবারে স্বশরীরে গভীরে ডুব দিয়েছেন। তারপরেও তিনি কৌশলগত কারণে একটু দূর অবস্থান থেকে ‘গল্পটি’ বলার চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসের প্রথমবাক্যেই তিনি তার দূরত্বটি তুলে ধরেন। ‘সজীব আবারও স্লোগানের কথা মনে করে। অনেকেই তা শোনে। তবে তা কখন, একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে বলতে পারিনা।’ তিনি বললেন ‘অনেকেই তা শোনে’। বললেন না ‘আমরা অনেকেই শুনি’ এমনি কৌশলী তিনি। এর আগের বাক্যেই তিনি বলছেন ‘ স্লোগানের কথা মনে করে।’ মনে করলেই শোনার কথাতো নয়। তাই তিনি শুনেন নি। অন্যের শোনার সম্ভানার খবরটি দিচ্ছেন মাত্র।
পুরো উপন্যাসটি স্লোগানের; ব্যাপক ভাবে বলতে গেলে আওয়াজের উপর আছে। অবশ্য এই আওয়াজ তার একটি প্রিয় শব্দ। খুব কৌশলে তিনি এই আওয়াজ পরিবেশন করেন। যেমন বলছেন- ‘স্লোগানে স্লোগানে, আওয়াজে আওয়াজে দেশবাড়ির গল্প এগোয়।’ ৭। এই আওয়াজের জন্যই এক একজন হিরো হয়ে উঠে। ‘আওয়াজের সন্ধ্যা কোত্থেকে আসে…’ / ‘আওয়াজের কন্ট্রোল নিয়ে আসেন।’৩৬। ‘ফাঁসির আওয়াজ প্রথমেই হয়…’৩৭। এমনকি ‘আওয়াজ দিয়ে তারা আওয়াজ মাপে।…’৬৮। ‘মানুষ অনুপাতে মানুষের চিৎকার অত জোরে কি করে হয়। যেন আওয়াজের হাট বসেছে, নাকি সমানে এর চাষাবাদ হচ্ছে।’৮৯। ‘আর কিছু না থাক, আওয়াজের একটা ব্যবস্থাতো করাই লাগবে।’১৩৫। তাই ‘এই যে আওয়াজ, এই যে সুরেলা আজানের মতোই বাজতে বাজতে কানে আসতে থাকা সম্মিলিত এক চাওয়াও আমরা প্রত্যক্ষ করি।’ একপর্যায়ে বলছেন ‘আওয়াজ সংক্রান্ত গালগল্পতে নিমজ্জিত হতে বাধ্য হবো।’৩৯। এমনি বাদ্যবাদকতাময় চাপ প্রায় ক্ষেত্রেই পাঠকের উপর পড়েছে। হয়ত তার গদ্যভঙ্গিটাই এমন যে, গদ্যের শ্রোতজালে (কারেন্টজাল) পাঠক ধরা পড়ছেন। এমনিভাবে বলছেন ‘কারণ খোঁজার জন্য জীবন বৃত্তান্তে প্রবেশ করতে বাধ্য হয় (হই?)….’৭। ‘সময় পার হয়, আমরা একসময় থেকে অন্য সময়ে প্রবেশ করাত বাধ্য হয়।’৬৮।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গদ্যের একটা বিশেষ প্রবণতা হচ্ছে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে এমনভাবে যান অমনযোগি পাঠক খেই হারাতে পারেন। লেখক প্রতিটি লাইনে কোথাও না কোথাও একটা চাবিসূত্র রেখে দেন। এই ক্ষেত্রে পাঠকের মানোযোগ দাবি করছেন। যেমন জয়ন্তীর মোবাইল বন্ধ থাকা থেকে যে ভাবনা শুরু হলো সেখান থেকে সংখ্যালঘু হামলার দিকে যেতে সজীবের মানষ পরিভ্রমণটি শুরু হলো।৭৫। এমনভাবে পুরো উপন্যাসের মনষ্কামনাটি তিনি কথার কথা হিসেবে বলতে থাকেন। ‘এইটা হয়ত এমন এক বাড়ি হবে যেখানে গোটা দেশটাকেই দেখা যাবে। সেখানে শহীদ মিনার, স্মৃতিস্তম্ভ, স্বপ্নের ভাস্কর্যরা থাকবে। … শুধু স্লোগান আর গান-বাদ্য নয়, লড়াই চলবে, ভাত কাপড়ের লড়াই, সাচ্চা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার লড়াই।”৭৬। এই স্বপ্ন হয়তো অসম্ভব; হয়ত ইউটোপিক। কিন্তু প্রতিটি তোলপাড় সময়ে মানুষ এমনি করে স্বপ্নের আশ্রয়ী হয়ে পড়ে। বিপরীত বিন্দু থেকে দেখলে স্বপ্নাশ্রয়ী হয় তখনই যখন মানুষ চরম অনিশ্চয়তায় ভোগে। তিনিও হয়ত ঘটনার ব্যাপকতা বুঝাতে এই তার চরিত্রদেরকে সেই মত স্বপ্নগত দেখিয়েছেন বারবার।
আর প্রধান চরিত্র সজীবের প্রবণতা হলো ‘ঝাঁকি’। এই সজীব আছে পুরা ঝাঁকির উপর। উপন্যাসের একেবারে শেষ পর্যন্ত আছে এই ‘ঝাঁকি’। “শরীরে আবার এতো জোরে ঝাকিঁ কেন লাগে? সে কি যুদ্ধের ভিতর পড়ে যাচ্ছে।”১৩২। প্রত্যেক চরিত্র যেন আলাদা ‘মায়ার জগত’ দিয়ে তৈরী। তারা সবসময় থাকে ভাবের ভিতর, একধরনের রোশনাইয়ের ভিতর। আমাদের একেবারে চেনা চরিত্ররা ড. জাফর ইকবাল-প্রফেসার ইয়াসমিন, ব্লগার রাজিব, লাকি আক্তারও অনেক ক্ষেত্রে একেবারে অচেনা হয়ে উঠেছে। ‘চিৎকার থেকেই এমন ভাবে তাকান যে তার সময় বদলে গেছে, যেন মানুষটা একাত্তর হয়ে গেছে।’ এভাবে চেনা মানুষের ভেতর থেকে অচেনা মানুষকে বের করে আনছেন। এভাবেই চেনা মানুষগুলোর ভেতরে বসবাসকারী খলমন (রাজাকার) শব্দ আঁচড়ে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন।
প্রধান চরিত্র সজীবের অনেক কিছুই মেলানো কঠিন। সারা উপন্যাসে তাকে মনে হতে পারে ছাত্র। মনে থাকেনা সে একজন চাকুরীজিবী। মনে হবে সে একজন আর্ট কলেজের ছাত্র যার ছাত্রত্ব শেষ হয়নি। সজীবের মানস জগৎ বোঝার জন্য যতটা না তার পেশা-শিক্ষার পরিচয় পাচ্ছি তারচেয়ে বেশী পাওয়া যায় ‘সজীবের নানীজান আর দাদার কিছু আচার-আচরণ এখানে আমরা স্মরণ…’৭৩। যেন সজীবের এই গুণটি ‘জেনেটিক’। তার প্রধান পার্শ্ব চরিত্র জয়ন্তীর চাইতে মায়ানুর বেগম বেশী বিস্তারিত। আন্দোলন চরিত্র ও সঙ্গম সম্পর্কে জয়ন্তীর দাবীই বেশী। এমনি বিপ্রতীপ হয় সজীবের রুমী স্কোয়াডে যোগ দেওয়া। যদিও তার আন্দোলনস্থান চট্টগ্রামের জামালখাঁন। সমান্তারালের চরিত্র সোহেল খানের জন্ম – উৎপত্তি যাই হোক সে শাহবাগ আন্দোলনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থক। প্রতিটি চরিত্রের বয়স-বৈবাহিক-অবস্থা-যৌনপ্রকরণ ঘটনা পরস্পরায় অসম। মায়ানুর বেগমের যে উৎপত্তি বিকাশ সবকিছু মিলিয়ে এমনকি মাটি ভেদ করে উদ্ভিদ জন্মের মিথ পর্যন্ত আছে। ৭০। কিন্তু এই মায়ানুর যুদ্ধশিশু হিসেবে জন্মই সার। তার আর কোন যাদু-মায়া দেখাতে পারছেনা। এতোবড় দক্ষযজ্ঞে সে খালি সজীবের মডেল হিসেবেই কাজ পেল! এই ধরনের এমনি নানান কাব্যিক দ্বান্দ্বিকতায় উপন্যাসটি মুখর। এক এক পাঠে এক এক বোধ তৈরী করে দেয়। যদিও এই প্রকরণ এই উপন্যাসটিকে একটি কাব্যিকমাত্রা দিয়েছে। যা পাঠককে একটি কবিতার বইয়ের মতো ধরে রাখতে পারে।
তাঁর গল্পে সবসময় প্রতিগল্পও থাকে। গল্পের ভেতর গল্প বলার একটা প্রবণতা সবসময় সক্রিয়; এই গল্পপাজল মিলিয়ে পাঠকে এগিয়ে যেতে হবে। এই পাজলের কোনাগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে, গল্পের বাঁকগুলো অনেকটা অমসৃন থেকে গেছে। ৯০। ‘হঠাৎই সজীবের কাঁধের কাছে মৃতের খাটিয়া দিয়ে স্পর্শ করার মতোই ছায়ার মতো কে যেন বলে, বাবাজী, আছেন কেমন? মানুষটাকে দেখেই সে দারুন চমকে উঠে, সোহানপুরের মুক্তিযুদ্ধের সারা চেহারা যেন তার কাছে স্পষ্ট….’ ১০১। ‘এমনকি সে যখন অন্ধকারের ভিতর একটা আলোর রেখার মতো একটা লেখা পড়ে যাতে লেখা আছে, “এইখানে একদা আমাদের কর্নেল এসেছিলেন।’ তখনই কর্নেল সংক্রান্ত…’
বইয়ের শেষ দিকে এর মুদ্রণ বিন্যাসে (ফরম্যাটে) আলাদা হেলানো অক্ষরে সজীবের ফেসবুক বক্তব্য দেখানোর প্রয়োজন হয়ত ছিল না। কারণ উপন্যাসের সরাসরি একটি চরিত্র যাই করুক বিবরণ সাধারণ ভাবে আসবে। একই ভাবে ট্রেসিং থেকে পিক্সেল উঠে দুইটি পৃষ্ঠায় (১২৬-১২৭) বেশকিছু অংশ পাঠোদ্ধার কষ্ঠসাধ্য। আরো আছে ব্যাপক মুদ্রণপ্রমাদ। যা সমগ্রপ্রকাশনাটি প্রস্তুতের সময়স্বল্পতার প্রমাণ দিচ্ছে।
ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে শাহাবাগ আন্দোলনের প্রধান নিয়ামক ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই মাধ্যমটিকে তিনি সেই ভাবে উপস্থাপন করেননি। হয়তো করতে চাননি। তার বিকল্পে দাঁড়িয়েছে সোহানপুরের অচিন বৃক্ষ। এই ব্রতেই উপন্যাসের বোধসমগ্র বোধির মতো জড়িয়ে রেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগের অন্যএকটি দিক ‘ব্লগার বংশ’ নিয়ে বিস্তারিত কিছুই উল্লেখ করেন না। তেমনি উল্লেখ করেন হেফাজত আন্দোলনের বিস্তারিত দিক। তিনি এই উপন্যাসে কোন ধরনের ঐতিহাসিকতাকে স্পর্শ করনেনি। তিনি হয়তো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতেও চাননি। এখানে আছে সাম্প্রতিকতা। এখানে তিনি যেন এক রির্পোটার মাত্র। তিনি খবররের পর খবর তৈরী করেছেন আর ‘বেখবরের’ মতো পরিবেশন করেছেন একটার পর একটা। এই সব খবরের জন্য এক একটি চরিত্র তিনি বেছে নেন। যেমন প্রধান চরিত্রটি ‘সজীব’। অন্যটি মায়ানুর বেগম। এই দুটি চরিত্রের ইতিহাস খুব আলতো ভাবে খুব সহজ ভাবে সজীবের ভাবনার সমান্তরালে মায়ানুর বেগম আলতো রেখে দেন যে কিছুই হয়নি; অথবা এমনই তো হয়।
তার পরিবেশন গুণে এমনকি একটি গাছও সচল চরিত্রের রূপ পেয়ে গেছে। ৩৩। একটি গাছও সচল চরিত্র হয়ে উঠেছে। এই বৃক্ষের সমস্ত মায়া মায়ানুর বেগমের জীবনের ভেতর প্রবাহিত হয়ে আছে। ৬৭। অচিন বৃক্ষ তার রক্তে ভর করে কিনা তাও কেউ কেউ তথ্য-তালাশের ভিতর রাখে। ৩৪। আরো একটি নারী চরিত্র আছে মুক্তিযোদ্ধার অনাথ মেয়ে চাঁনতারা বেগম। এই বৃক্ষের মতোই আরেকটি জড় চরিত্র মাদ্রাসা।
আমরা আবার আনোয়ার পাশার কাছে ফেরত যাই। ওখানেও ছিল সাম্প্রতিকতা। তবে এখানকার সাম্প্রতিকতার বিবরণ অনেক কাব্যিক। কখনো কখনো একটি রাস্তাও মানসিক বোধের মতো কাব্যিক ভঙ্গিতে উঠে এসেছে অনেক সময় “অনেকগুলি শাখা রাস্তা শহরের এখানে সেখানে আসে। তবু তারা রাস্তা পিপাসু – রাস্তা যখন রাস্তা পিপাসু তখন তাকে তো আলাদা একটা গুরুত্ব দিতেই হয়। এর পাহাড় ও যেন নদীর মতো রাস্তা পিপাসু। এমনটি কমই দেখা যায়, যেখানে পাহাড়ই একটা শহরকে পথ দেখায়; মানুষ করে রাখে।” ৩৮। “এরা চা-যতনা খায়, শব্দ খায় তার চেয়েও বেশী।”৩৯। “নরম চুপচুপ বিকালের উপর শীতের সামান্য ছোঁয়া সন্ধ্যা আসতে শুরু করেছে।”। ৪৭। “…সেই আলোয় অন্ধকার আরো সরে সরে যায়। ফজরের আজানের পর তা আরো দূরীভ‚ত হতে থাকে। এক সময় ডিমের কুসুমের ছোঁয়া লাগতে লাগতে তার ভিতর থেকে লালাভ ধারা প্রবাহিত হতে থাকে।” ৭২। এমন কবিতাময় অনেক উদ্ধৃতি পাঠকের অপেক্ষায়। এমনি এক ব্যাপক কাব্যিক ঘোরে থেকেছেন তিনি। তারপর শব্দসুতোয় প্রতিটি ঘোরকে নিপুনতায় জুড়ে দিয়েছেন।
সমস্ত আলোচনা শেষ করে অতুল চন্দ্র গুপ্তের এই মন্তব্য ’দৃষ্টি দিয়ে তার উপন্যাসটির দিকে আরো একবার তাকাই…..“কাব্যের জগত বস্তুর জগত নয়, মায়ার জগত – একথা সত্য। কিন্তু বস্তুনিরেপেক্ষ মায়া হয় না; অবাস্তব কাব্য সম্ভব। এবং কাব্যের কথবস্তুর বস্তুপরতার লাঘবতা যদি তার রস-আকর্ষণ শক্তির হীনতা ঘটায় তবে সে লাঘবতা কাব্যের দোষ। কিন্তু কথাবস্তুর লক্ষ্য বস্তু নয়, রস। কাব্য যে বস্তুকে চিত্রিত করে, সে তার বাস্তবতার জন্য নয়, রসাভিব্যক্তির জন্য। কাজেই উপায় যদি উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যায় তবে ঠিক বিপরীত অনৌচিত্তের দোষে কাব্য রসভঙ্গ নয়। বস্তুর বাস্তবতা অনন্ত। কোন কবিই তা সবটাকে কাব্যের কথাবস্তুতে স্থান দিতে পারেন না। যদি পারতেন, তবে তার ফলে যা সৃষ্টি হোতো; তা আর যাই হোক – কাব্য নয়। সুতরাং ঐ বাস্তবতা কতটা কোন কাব্যে স্থান পাবে, সম্পূর্ন নির্ভর করে কাব্যের উদ্দিষ্ট রসের উপর ও কবির প্রতিভার প্রকৃতির উপর… কেউ কাকেও কাব্যের জগৎ থেকে নির্বাসনে দেবার অধিকারী নয়।” আর তাই বলা যায় বাস্তবতার খাতিরেই বস্তবতা প্রকাশ কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়… হুমায়ূন আহমেদের জোৎস্না ও জননীর গল্প অথবা দেয়াল এর একটি ভালো উদাহারণ।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর নিজস্ব চয়ন কৌশলে তার শাহবাগ আন্দোলনের ‘great, strange and beautiful’ দেখানো চেষ্টা করেছেন। তার এই চেষ্টা তখনই সফল হবে যখন পাঠক এই চেষ্টাটি উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন।